১২:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শালিখায় বিলুপ্তির পথে বাবুই পাখি

বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্রালিকার পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি ঝড়ে। বাসা তৈরিতে যার নিপুণ কাজ সে তো শিল্পের বড়াই করতেই পারে। কিন্তু কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী কবিতাটির নায়ক গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাবুই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে।

প্রতিকূল পরিবেশ, বৈরী আবহাওয়া, শিকারীর উপদ্রব ও নির্বিচারে বৃক্ষ রোধনসহ নানা কারণে তাঁত পাখি নামে পরিচিত এই নিপুণ নীড় তৈরির গারিগরগুলো আজ হুমকিতে। একসময় গ্রাম্য বাড়ির বাইর উঠানে তালগাছের পাতায় পাতায় দেখা যেত বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। কিন্তু গ্রামের পথ ধরে অনেকসময় হাঁটলেও এখন বাবুই ও তার বাসা চোখে মেলা ভার।

নিখুঁত শিল্পের কারুকাজ মন্ডিত নীড় তৈরির জন্য বাবুই পাখিকে শিল্পের কারিগর বলা হয়। নানা কারণেই পাখিদের মধ্যে বাবুই পাখিই সেরা। এক সময় ঐতিহ্যবাহী মাগুরা তথা শালিখা উপজেলার বসতবাড়ি কিংবা সড়কের পাশে উঁচু নারকেল, খেজুর, রেইনট্রি, সুপারী, তালগাছসহ বিভিন্ন গাছের মগডালে অসংখ্য বাবুই পাখি ও দৃষ্টিনন্দন বাসার দেখা মিলতো।

কালের বিবর্তণে এসব পাখির উপস্থিতি আর তেমন চোখে পড়েনা। বিভিন্ন তথ্যমতের ভিত্তিতে জানা গেছে, পৃথিবীতে প্রায় ১১৭ প্রজাতির বাবুই পাখি রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির বাবুই পাখির বাস রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দেশী বাবুই, দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুই। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এ ধরণের বাবুই পাখির বিচরণ নেই।

বাংলা ও দাগি বাবুই এর দেখা না মিললেও মাঝে মাঝে শুনা যায় দেশি বাবুইপাখির মন মাতানো কিচিরমিচির শব্দ। কথিত আছে পুরুষ বাবুইর তৈরি বাসা পছন্দ হলেই স্ত্রী বাবুই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের আঁধারে বাসা আলোকিত করার জন্য জোঁনাকি পোকা ধরে বাসায় এনে রাখে। নিজের ঠোট দিয়ে তৈরি বাসাটিকে সর্বোচ্চ আগলে রাখে ঝড় বৃষ্টির সময়।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার ভাটোয়াইল, গঙ্গারামপুর, শ্রীহট্ট, বইখোলা, কুয়োতপুর, শরশুনা, আনন্দনগরসহ  বিভিন্ন এলাকার বসতবাড়ি কিংবা সড়কের পাশে উঁচু গাছে বাবুই পাখির বাসা। এর মধ্যে বেশীর ভাগ তালগাছের পাতায় বাবুইরা বাসা বেঁধেছে। শুরুতে বাসায় দুটি নিম্নমুখী গর্ত রাখে। মাত্র চার দিনে বাসা বাঁধার কাজ শেষ করে। বাসার নিম্নমুখী একটি গর্ত বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা করে নেয়। অন্যটি খোলা রাখে প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য। বাসার ভেতরে-বাইরে কাদা লাগিয়ে রাখে। ফলে প্রবল ঝড়ে বা বাতাসেও টিকে থাকে বাসা। সাধারণত মে থেকে আগস্ট মাস বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। বাবুই পাখি দুই থেকে চারটি ডিম দেয়। স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। তিন সপ্তাহ পর বাচ্চা উড়ে যায়। এরা মূলত বীজভোজী পাখি। এরা সাধারণত খুঁটে খুঁটে বিভিন্ন ধরনের বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে। বাবুই পাখিরা তালগাছ-খেজুর গাছে বাসা বাঁধতে পছন্দ করলেও এসব গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে অন্যান্য গাছেও বাসা বাঁধতে দেখা গেছে। তবে পাখি শিকারীদের দৌরাত্ম্যে বাবুই পাখিগুলো এখন চরম হুমকিতে।

স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমানযুগে কোন কোন স্থানে বাবুই পাখি দেখা তার সংখ্যা খুবই কম। কালের বিবর্তণে ঐতিহ্যবাহী বাবুই পাখি দিনদিন বিলুপ্তির পথে। কারণ হিসেবে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, বৈরী আবহাওয়া,  বিরুপ পরিবেশ, উচু গাছের সংখ্যা হ্রাস বলে মনে করছেন সচেতল মহল। এছাড়াও পাখি শিকারীর  কবলে পড়ে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জের চিরচেনা রূপ। আনন্দনগর গ্রামের ইকতার লস্কার বলেন, দীর্ঘ ছয় মাস ধরে আমার একটি তালগাছে বাবুই পাখি বাসা বেঁধেছে তবে শিকারীদের উৎপাতে তারা সেখান থেকে চলে যাচ্ছে।

আড়পাড়া ইউনিয়নের শ্রীহট্ট গ্রামের রাজু আহমেদ বলেন, আমাদের বাড়ির পাশে একটি গাছে বাবুই পাখি বাসা বেঁধেছে যা দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র-ছাত্রী ও পাখিপ্রেমি মানুষরা দেখতে আসতো কিন্তু এখন আর সেখানে কোনো বাবুই পাখি নাই। বিলুপ্ত প্রায় এই প্রাণীগুলোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন পাখি প্রেমি মানুষেরা।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Popular Post

ফিনল্যান্ড 5 বছরের কাজের ভিসা | ফিনল্যান্ডে দক্ষ এবং অদক্ষ চাকরি নিয়োগ এপ্রিল-মে 2024 এখনি এপ্লাই করুন.

শালিখায় বিলুপ্তির পথে বাবুই পাখি

Update Time : ০১:৫০:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৩

বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্রালিকার পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি ঝড়ে। বাসা তৈরিতে যার নিপুণ কাজ সে তো শিল্পের বড়াই করতেই পারে। কিন্তু কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী কবিতাটির নায়ক গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাবুই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে।

প্রতিকূল পরিবেশ, বৈরী আবহাওয়া, শিকারীর উপদ্রব ও নির্বিচারে বৃক্ষ রোধনসহ নানা কারণে তাঁত পাখি নামে পরিচিত এই নিপুণ নীড় তৈরির গারিগরগুলো আজ হুমকিতে। একসময় গ্রাম্য বাড়ির বাইর উঠানে তালগাছের পাতায় পাতায় দেখা যেত বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। কিন্তু গ্রামের পথ ধরে অনেকসময় হাঁটলেও এখন বাবুই ও তার বাসা চোখে মেলা ভার।

নিখুঁত শিল্পের কারুকাজ মন্ডিত নীড় তৈরির জন্য বাবুই পাখিকে শিল্পের কারিগর বলা হয়। নানা কারণেই পাখিদের মধ্যে বাবুই পাখিই সেরা। এক সময় ঐতিহ্যবাহী মাগুরা তথা শালিখা উপজেলার বসতবাড়ি কিংবা সড়কের পাশে উঁচু নারকেল, খেজুর, রেইনট্রি, সুপারী, তালগাছসহ বিভিন্ন গাছের মগডালে অসংখ্য বাবুই পাখি ও দৃষ্টিনন্দন বাসার দেখা মিলতো।

কালের বিবর্তণে এসব পাখির উপস্থিতি আর তেমন চোখে পড়েনা। বিভিন্ন তথ্যমতের ভিত্তিতে জানা গেছে, পৃথিবীতে প্রায় ১১৭ প্রজাতির বাবুই পাখি রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির বাবুই পাখির বাস রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দেশী বাবুই, দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুই। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এ ধরণের বাবুই পাখির বিচরণ নেই।

বাংলা ও দাগি বাবুই এর দেখা না মিললেও মাঝে মাঝে শুনা যায় দেশি বাবুইপাখির মন মাতানো কিচিরমিচির শব্দ। কথিত আছে পুরুষ বাবুইর তৈরি বাসা পছন্দ হলেই স্ত্রী বাবুই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের আঁধারে বাসা আলোকিত করার জন্য জোঁনাকি পোকা ধরে বাসায় এনে রাখে। নিজের ঠোট দিয়ে তৈরি বাসাটিকে সর্বোচ্চ আগলে রাখে ঝড় বৃষ্টির সময়।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার ভাটোয়াইল, গঙ্গারামপুর, শ্রীহট্ট, বইখোলা, কুয়োতপুর, শরশুনা, আনন্দনগরসহ  বিভিন্ন এলাকার বসতবাড়ি কিংবা সড়কের পাশে উঁচু গাছে বাবুই পাখির বাসা। এর মধ্যে বেশীর ভাগ তালগাছের পাতায় বাবুইরা বাসা বেঁধেছে। শুরুতে বাসায় দুটি নিম্নমুখী গর্ত রাখে। মাত্র চার দিনে বাসা বাঁধার কাজ শেষ করে। বাসার নিম্নমুখী একটি গর্ত বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা করে নেয়। অন্যটি খোলা রাখে প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য। বাসার ভেতরে-বাইরে কাদা লাগিয়ে রাখে। ফলে প্রবল ঝড়ে বা বাতাসেও টিকে থাকে বাসা। সাধারণত মে থেকে আগস্ট মাস বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। বাবুই পাখি দুই থেকে চারটি ডিম দেয়। স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। তিন সপ্তাহ পর বাচ্চা উড়ে যায়। এরা মূলত বীজভোজী পাখি। এরা সাধারণত খুঁটে খুঁটে বিভিন্ন ধরনের বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে। বাবুই পাখিরা তালগাছ-খেজুর গাছে বাসা বাঁধতে পছন্দ করলেও এসব গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে অন্যান্য গাছেও বাসা বাঁধতে দেখা গেছে। তবে পাখি শিকারীদের দৌরাত্ম্যে বাবুই পাখিগুলো এখন চরম হুমকিতে।

স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমানযুগে কোন কোন স্থানে বাবুই পাখি দেখা তার সংখ্যা খুবই কম। কালের বিবর্তণে ঐতিহ্যবাহী বাবুই পাখি দিনদিন বিলুপ্তির পথে। কারণ হিসেবে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, বৈরী আবহাওয়া,  বিরুপ পরিবেশ, উচু গাছের সংখ্যা হ্রাস বলে মনে করছেন সচেতল মহল। এছাড়াও পাখি শিকারীর  কবলে পড়ে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জের চিরচেনা রূপ। আনন্দনগর গ্রামের ইকতার লস্কার বলেন, দীর্ঘ ছয় মাস ধরে আমার একটি তালগাছে বাবুই পাখি বাসা বেঁধেছে তবে শিকারীদের উৎপাতে তারা সেখান থেকে চলে যাচ্ছে।

আড়পাড়া ইউনিয়নের শ্রীহট্ট গ্রামের রাজু আহমেদ বলেন, আমাদের বাড়ির পাশে একটি গাছে বাবুই পাখি বাসা বেঁধেছে যা দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র-ছাত্রী ও পাখিপ্রেমি মানুষরা দেখতে আসতো কিন্তু এখন আর সেখানে কোনো বাবুই পাখি নাই। বিলুপ্ত প্রায় এই প্রাণীগুলোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন পাখি প্রেমি মানুষেরা।